মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

কুষ্টিয়ার কিছু ব্যক্তিত্ত্ব

কুষ্টিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচিত কিছু ব্যক্তিত্ত্ব

 বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ




বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহজন্ম : ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ)
মৃত্যু : ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ)
লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০) বাউল সাধনার প্রধান গুরু, বাউল গানের সর্বশ্রেষ্ঠ রচয়িতা ও গায়ক। তাঁকে বাউল সম্রাট হিসেবে অভিহিত করা হয়।

বাউল সম্রাট লালন শাহ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ভাঁড়রা গ্রামে ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ) এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মতান্তরে তাঁর জন্মস্থান ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে।

কথিত আছে লালন শাহ যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমণে বের হলে পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সঙ্গীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যান। এসময় সিরাজ সাঁই নামে একজন মুসলমান ফকির তাঁকে মুমূর্ষ অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন শাহ তার নিকট বাউলধর্মে দীক্ষিত হন।

বাউলধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর কুষ্টিয়া শহরের অদূরবর্তী ছেঁউড়িয়া নামক স্থানে একটি আখড়া নির্মাণ করে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস করতে থাকেন। তাঁর কোন সন্তান ছিল না। মৃত্যুকালে ১০ হাজারেরও বেশি শিষ্য ছিল তাঁর।

লালন শাহ কোন বিশেষ ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, অথচ সকল ধর্মের লোকই তাঁকে আপন মনে করত। মুসলমান, হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের সাথে তাঁর সদ্ভাব ছিল। তিনি কোন জাতিভেদ মানতেন না। তাই তিনি গেয়েছেন,

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন ভাবে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।
******
কেউ মালা কেউ তসবি গলায়,
তাহাতে যে জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।
*****
যদি সন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কি হয় বিধান,
বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ
বামণি চিনি কিসে রে।।
*****

বাউল সম্রাটের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে সেই জ্ঞনের পরিচয় পাওয়া যায়। আধ্যাতিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেন।

তাঁর গান মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ।সহজ সরল শব্দময় অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর গানে মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।

লালনের আখড়া ছেঁউড়িয়া থেকে ছয় মাইল দূরে শিলাইদহে অবস্থানকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনগীতির কয়েকটি আদি পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। বর্তমানে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র-ভবন গ্রন্থাগারে লালন গীতির তিনটি আদি পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।

শেষ বয়সেও তিনি ঘোড়ায় চড়তে সমান দক্ষ ছিলেন এবং ঘোড়ায় চড়েই বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। জানা যায়, মৃত্যুর প্রায় এক মাস পূর্বে তাঁর পেটের অসুখ হয় এবং হাত-পায়ে পানি এসে ফুলে যায়। এসময় তিনি দুধ ছাড়া আর কিছু খেতেন না, তবে মাছ খেতে চাইতেন। মৃত্যুর আগের রাতে বহু সময় ধরে গান করে ভোর পাঁচটার দিকে শিষ্যগণকে বলেন, ‘আমি চললাম’। তার কিছুক্ষণ পরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ) রোজ শুক্রবার ভোরবেলা বাউল জগতের এই প্রধান পুরুষ বাউল সম্রাট লালন শাহ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়ার নিজ আখড়ায় ১১৬ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।

প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা (মার্চ-এপ্রিল) ও মৃত্যুবার্ষিকীতে (অক্টোবর) ভক্তরা তাঁর মাজারে সমবেত হন এবং সাধুসেবা ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কুষ্টিয়া এ সময় উৎসবের শহরে পরিণত হয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম : ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ ; ৭ মে, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু : ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ ; ৭ আগস্ট, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার ও দার্শনিক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তিনি তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তার সারা জীবনের কর্মে সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তিনি বিশ্বকবি, কবিগুরু ও গুরুদেব নামে পরিচিত। বলা যায় তাঁর হাতে বাঙ্গালীর ভাষা ও সাহিত্য,শিল্পকলা ও শিল্প চেতনা নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে।

তিনি বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত জন গণ মন উভয়টির রচয়িতাই রবীন্দ্রনাথ।

কলকাতার পিরালী ব্রাহ্মণ সমাজের অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। ১৮৭৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম ছোট গল্প এবং নাটক লিখেন। এর আগেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত কাব্যের জন্ম দিয়েছিলেন যা ভানুসিংহ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। পারিবারিক শিক্ষা, শিলাইদহের জীবন এবং প্রচুর ভ্রমণ তাকে প্রথাবিরুদ্ধ এবং প্রয়োগবাদী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। তিনি ব্রিটিশ রাজের প্রবল বিরোধিতা করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তার পুরো পরিবারের পতন এবং বাংলার বিভক্তিরেখার নিদর্শন তাকে দেখতে হয়েছিল। এদিক থেকে তার জীবনকে দুঃখী বলতেই হয়। কিন্তু তার কবিতা, অন্যান্য সাহিত্য আর বিশ্বভারতী প্রতিণ্ঠা তার জীবনকে যে মহিমা দান করেছে তা আজীবন হয়তোবা টিকে থাকবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদা দেবীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ১৩তম। জন্মের সময় তার ডাক নাম রাখা হয় রবি। ১১ বছর বয়সে তার উপনয়ন সম্পন্ন হওয়ার পর ১৮৭৩ সনের ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখে ঠাকুর তার বাবার সাথে কলকাতা ত্যাগ করেন ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে যান তারা। এর মধ্যে ছিল শান্তিনিকেতনে দেবেন্দ্রনাথের নিজস্ব সম্পত্তি, অমৃতসর এবং হিমালয় অধ্যুষিত পাহাড়ি স্টেশন ডালহৌসি। সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির জীবনী পড়েন, অধ্যয়ন করেন ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আধুনিক বিজ্ঞান এবং সংস্কৃত। এছাড়াও তিনি কালিদাসের ধ্রুপদি কাব্যের সাথে পরিচিত হন ও এর বিভিন্ন পর্যালোচনা করেন।

১৮৭৭ সনে তিনি প্রথম জনসম্মুখে পরিচিতি লাভ করেন। কারণ এ সময়েই তার কিছু সাহিত্যকর্ম প্রথম প্রকাশিত হয়। এর মধ্য ছিল মৈথিলি ভাষার সাংস্কৃতিক আদলে রচিত কিছু সুদীর্ঘ কবিতা। এ ধরণের কবিতা প্রথম লিখেছিলেন কবি বিদ্যাপতি। এই কবিতাগুলো সম্বন্ধে কৌতুক করে তিনি একবার বলেছিলেন, এগুলো হচ্ছে ভানুসিংহের (সপ্তদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব কবি যার নাম অনেক পরে পরিচিতি লাভ করেছে) হারিয়ে যাওয়া কাব্য সংগ্রহ। একই বছর তিনি লিখেন ভিকারিনী যা বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোট গল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। ১৮৮২ সনে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সন্ধ্যা সংগীত প্রকাশিত হয় যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ নামক বিখ্যাত কবিতাটি।

১৮৭৮ সনে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন। তাকে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পড়াশোনা করেন। কিন্তু ১৮৮০ সনে কোন ডিগ্রি লাভ ছাড়াই তিনি বঙ্গে ফিরে আসেন।

১৮৮৩ সনে তিনি মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন বিয়ের সময় যাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। জন্মের সময় মৃণালিনীর ডাক নাম ছিল ভবতারিণী (১৮৭৩ - ১৯০২)। তাঁদের পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়েছিল যাদের মধ্যে ২ জন শিশুকালেই মারা যায়।

১৮৯০ সাল থেকে ঠাকুর শিলাইদহে তার বাবার সম্পত্তির দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা শিলাইদহে তাঁর সাথে যোগ দেয়। সেই সময় জমিদার বাবু নামে পরিচিত রবি ঠাকুর, পরিবারের আরামদায়ক জীবন ত্যাগ করে পদ্মার কোল জুড়ে বিপুল পরিমাণ এলাকা ভ্রমণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল তার ভূমিতে বসবাসকারী গ্রাম্য অধিবাসীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং তাদের সাথে কথা বলে আশীর্বাদ করা। বিভিন্ন স্থানে তার সম্মানে গ্রামের লোকেরা উৎসবের আয়োজন করতো। এই বছরগুলোতে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলো গল্প রচনা করেন। তাঁর তিন খণ্ডে রচিত বিখ্যাত গল্প সংকলন গল্পগুচ্ছের (যাতে মোট ৮৪টি ছোট গল্প রয়েছে) প্রায় অর্ধেক গল্প এখানে থাকা অবস্থাতেই রচনা করেছেন। এই গল্পগুলোতে ব্যঙ্গ এবং আবেগের সমন্বয়ে গ্রাম বাংলার সঠিক চিত্র নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।

১৯০১ সনে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে শিলাইদহ ছেড়ে যান। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন মূলত একটি আশ্রম স্থাপনের লক্ষ্যে। এই আশ্রমে তিনি গড়ে তোলেন একটি মার্বেল পাথরের মেঝেবিশিষ্ট মন্দির, একটি পরীক্ষামূলক বিদ্যালয়, বাগান এবং গ্রন্থাগার। এখানেই রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মৃত্যু ঘটে। ১৯০৫ সনের জানুয়ারি ১৯ তারিখে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি মাসিক ভাতা ও বেতন পেতে শুরু করেন। এছাড়াও তিনি ত্রিপুরার মহারাজা, পারিবারিক গহনার ব্যবসা, পুরিতে অবস্থিত বাংলো এবং নিজ সাহিত্যকর্মের সম্মানী; এই উৎসগুলো থেকে অর্থ পেতেন। প্রকাশনার সম্মানী হিসেবে তিনি প্রায় ২,০০০ টাকা পেতেন। এসময় তার সাহিত্যকর্ম দেশে-বিদেশে বিপুল পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এরপর ১৯০১ সনে নৈবেদ্য এবং ১৯০৬ সনে প্রকাশ করেন কাব্যগ্রন্থ খেয়া। একই সাথে তার কবিতাগুলোকে free verse-এ রূপান্তরের কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৯১৩ সনের নভেম্বর ১৪ তারিখে তিনি জানতে পারেন, যে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পিছনে মূল ভূমিকা ছিল তারই লেখা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের সফল ইংরেজি অনুবাদ যার ফলে পাশ্চাত্যের পাঠকেরাও তার সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভে সক্ষম হয়েছে।

১৯২১ সালে ঠাকুর কৃষি অর্থনীতিবিদ লিওনার্ড কে এল্‌মহার্স্টের সাথে মিলে শান্তিনিকেতনের নিকটে অবস্থিত সুরুল নামক গ্রামে পল্লী পুনর্নিমাণ সংস্থা নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে এর নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন শ্রীনিকেতন। এই শ্রীনিকেতনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দেশ থেকে বিদ্বান ও পণ্ডিতদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এখানে গ্রামের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের বন্দোবস্ত করেন এবং তাদের মধ্যে বিশুদ্ধ জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস নেন।

১৯৩০-এর দশকে তিনি ভারতবর্ষের অস্বাভাবিক বর্ণবিভেদ এবং বর্ণে বর্ণে ধরা-ছোঁয়ার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মতামত প্রচার শুরু করেন। তিনি এই বর্ণবিভেদের বিপক্ষে বক্তৃতা, কবিতা রচনা, বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে নাটক রচনা এবং কেরালার একটি মন্দিরে এই প্রথা ত্যাগের আহ্বান জানানোর মাধ্যমে তার আন্দোলন পরিচালনা করেন। মূলত দলিতদের সাধারণ সমাজে অবাধ প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য।

জীবনের শেষ দশকের পুরোটা রবীন্দ্রনাথ জনসমক্ষে ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এসময় ছিল তুঙ্গে। ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারতের বিহার রাজ্যে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন যে, এটি দলিতদেরকে বশীভূত করার জন্য ঈশ্বরের একটি প্রতিশোধ। রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্যের জন্য গান্ধীকে জনসমক্ষে তিরস্কার করেন। এছাড়া বঙ্গের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি এবং কলকাতায় দরিদ্রতার প্রাদুর্ভাবের কারণে তিনি বিশেষ দুঃখ প্রকাশ করেন। ১০০ লাইনের একটি মিত্রাক্ষর বর্জিত কবিতায় তিরি তার এই বেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। দ্বিমুখী চিন্তাধারাকে ঝলসে দেয়ার এই কৌশল পরবর্তিতে সত্যজিত রায় পরিচালিত অপুর সংসার নামক চলচ্চিত্রে অনুসৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ এসময় তার লেখার সংকলন ১৫টি খণ্ডে প্রকাশ করেন। এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ছিল পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫) এবং পাত্রপুট (১৯৩৬)। তিনি prose-songs এবং নৃত্যনাট্য রচনার মাধ্যমে তার বিভিন্ন পরীক্ণ চালিয়ে যেতে থাকেন যার মধ্যে রয়েছে "'চিত্রঙ্গদা" (১৯১৪), "শ্যামা" (১৯৩৯) এবং "চণ্ডালিকা" (১৯৩৮)। এসময়ে রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে "দুই বোন" (১৯৩৩), "মালঞ্চ" (১৯৩৪) এবং "চার অধ্যায়" (১৯৩৪)।

জীবনের শেষ বছরগুলোতে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি বিশেষ আগ্রহের পরিচয় দেন যার প্রমাণ তার রচিত "বিশ্ব পরিচয়" (১৯৩৭) নামক একটি প্রবন্ধ সংকলন। তিনি জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন, তার সে সময়কার কবিতা এবং সাহিত্যকর্মে বিজ্ঞানের প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতি তার বোধগম্যতা আমাদেরকে সে প্রমাণই দেয়। এই সাহিত্যকর্মে উচ্চমানের প্রকৃতিবাদ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন গল্পে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করেন যার মধ্যে রয়েছে, "সে" (১৯৩৭), "তিন সঙ্গী" (১৯৪০) এবং "গল্পসল্প" (১৯৪১)।

জীবনের শেষ চার বছর রবীন্দ্রনাথের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা ছিল এবং তার এই দুরারোগ্য অসুস্থতা মোট দুই বছর বজায় ছিল। ১৯৩৭ সালের শেষ দিকে তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন এবং এরপর দীর্ঘ সময় মুমূর্ষু অবস্থায় কোমায় ছিলেন। তিন বছর পর ১৯৪০ সালে আরেকবার ভাল রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন যা থেকে আর আরোগ্য লাভ করতে পারেন নি।

এসময় রচিত কবিতাগুলো তার জীবনের অন্যতম প্রধান রচনা হিসেবে খ্যাত কারণ এর মধ্যে মৃত্যু দুয়ারে তার পদচারণার আভাস প্রস্ফুটিত হয়েছিল।

দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তারিখে (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ির উপর তলার একটি কক্ষে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। এই ঘরেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার মৃত্যুবার্ষিকী এখনও বিশ্বের সকল প্রান্তের বাংলাভাষীরা বিশেষ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকে।

ঠাকুরের ভ্রমণের নেশা ছিল প্রখর। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সনের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশী দেশ ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো সফরেরই উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের বাইরে এবং অবাঙালি পাঠক এবং শ্রোতাদেরকে তার সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া এবং তার রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করা। যেমন ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে যাওয়ার সময় তিনি তার এক তাক বইয় নিয়ে যান এবং এই বইগুলো বিভিন্ন মিশনারি ব্যক্তিত্ব, গ্রান্ধী প্রতিজি চার্লস এফ অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্‌স, এজরা পাউন্ড রবার্ট ব্রিজেস, আর্নস্ট রাইস প্রমুথ অনেককেই মুগ্ধ করেছিল। এমনকি ইয়েট্‌স গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন এবং অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে তার সাথে যোগ দেন। ১৯১২ সালের ১০ নভেম্বর ঠাকুর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ভ্রমণে যান। যুক্তরাজ্যে তিনি অ্যান্ড্রুজের চাকুরিজীবী বন্ধুদের সাথে বাটারটন এবং স্ট্যাফোর্ডশায়ারে অবস্থান করেছিলেন। ১৯১৬ সালের মে ৩ থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা করেন। এইসব বক্তৃতায় তিনি জাতীয়তাবাদ- বিশেষত জাপানী এবং মার্কিন জাতীয়তাবাদের নিন্দা করেন। তিনি "ভারতে জাতীয়তাবাদ" নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন যাতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি বিদ্রুপ এবং এর প্রশংসা উভয়টিই ছিল। বিশ্বজনীন শান্তিবাদে বিশ্বাসীরা অবশ্য এর প্রশংসাই করে থাকেন যেমন করেছেন রোমাঁ রোঁলা। সেখান থেকে ভারতে ফিরে আসার পরপরই ৬৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ পেরুভিয়ান সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যান এবং একই সাথে মেক্সিকো যাওয়ার সুযোগটিও গ্রহণ করেন। তার সফরের সম্মানে উভয় দেশের সরকারই শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী শিক্ষাঙ্গণের জন্য ১০০,০০০ মার্কিন ডলার অনুদান দেয়। ১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়র্‌স-এ যান। কিন্তু সেখানে যাবার এক সপ্তাহের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-তে অবস্থিত Villa Miralrío-তে নিয়ে যাওয়া হয়। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একই বছরের ৩০ মে তিনি ইতালির নেপ্‌লসে পৌঁছেন এবং পরদিন ইতালির ফ্যাসিবাদী একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছিল। কিন্তু ১৯২৬ সালের ২০ জুলাই রবীন্দ্রনাথ প্রথম মুসোলিনির বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং এর ফলে তাদের মধ্যকার সে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। ১৯২৭ সালের ১৪ জুলাই ঠাকুর অন্য দুইজন সঙ্গী নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি স্থানে চার মাসের সফরে যান। এই স্থানগুলোর মধ্যে ছিল বালি, জাভা দ্বীপ, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম এবং সিঙ্গাপুর। তার সে সময়কার ভ্রমণকাহিনী যাত্রী নামক রচনায় স্থান পেয়েছে। ১৯৩০ সালের প্রথমদিকে তিনি ইউরোপ এবং আমেরিকায় বছরব্যাপী সফরের উদ্দেশ্যে বাংলা ত্যাগ করেন। সফর শেষে যুক্তরাজ্যে ফিরে যাওয়ার পর লন্ডন এবং প্যারিসে তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। এসময় তিনি বার্মিংহামে ধর্মীয় ভ্রাতৃসংঘের আশ্রয়ে অবস্থান করছিলেন। এখানে বসে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার বিখ্যাত হিবার্ট ভাষণ প্রস্তুত করেন। তার এই ভাষণের বিষয় ছিল আমাদের ঈশ্বরের মানবতাবোধ এবং মানুষ ও পরমাত্মার স্বর্গীয় রূপ। তিনি লন্ডনের বার্ষিক কোয়েকার সম্মেলনেও বক্তৃতা করেছিলেন। সেখানে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের সম্পর্ক যে বিষয়কে কেন্দ্র করে তিনি পরবর্তী দুই বছর অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছেন। একইসাথে তিনি "dark chasm of aloofness" নিয়েও কথা বলেছিলেন। তার পরবর্তী সফর ছিল ডার্টিংটন হলে অবস্থিত আগা খান ৩-এ। ডার্টিংটন হলেই তিনি অবস্থান করেছিলেন। এরপর ভ্রমণ করেন ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানি। ১৯৩০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়টা এভাবেই কেটে যায়। এরপর যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। সর্বশেষে ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের শাহ রেজা শাহ পাহলভি তাকে সরকারীভাবে আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ইরানী কবি হাফিজের অতিন্দ্রীয় ফরাসি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। শাহের আমন্ত্রণে তিনি ইরানে যান। এই ভ্রমণগুলোর মাধ্যমে ঠাকুর তৎকালীন সময়ের আলোচিত এবং বিখ্যাত অনেকের সাথে পরিচিত হন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেনরি বার্গসন, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস এবং রোঁমা রোঁলা। বিদেশে তার একেবারে শেষ সফরগুলোর মধ্যে ছিল ১৯৩২ সালে ইরান, ইরাক সফর; ১৯৩৩ সালে সেইলন ভ্রমণ। তার সকল ভ্রমণ সামগ্রিকভাবে তাকে মানুষে মানুষে বিভাজন এবং জাতীয়তাবাদের স্বরূপ অনুধাবন করতে সক্ষম করে তুলেছিল।

রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্য হচ্ছে তার কবিতা এবং গান। অবশ্য উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ভ্রমণ কাহিনী এবং নাটক রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কবিতা ও গান বাদ দিলে তার সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনা হচ্ছে ছোটগল্প। তাকে বাংলা ভাষায় ছোটগল্প রচনাধারার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সাহিত্যকর্মের ছান্দসিক, আশাবাদী এবং গীতিধর্মী রূপ সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। সাধারণ বাঙালিদের জীবনই ছিল তার প্রধান উপজীব্য। রবীন্দ্রনাথ আটটি উপন্যাস ও চারটি উপন্যাসিকা লিখেছেন যার মধ্যে রয়েছ চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা, চার অধ্যায় ও নৌকাডুবি। অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথের গানে প্রাচীন আইরিশ এবং স্কটিশ সুর ও ছন্দের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় , "পুরোনো সেই দিনের কথা" গানটির মূল সুর নেয়া হয়েছে স্কটিশ লোকগীতি "অল্ড ল্যাং সাইন" হতে। এছাড়া তার অনেক গানেই স্থানীয় বাউল গান, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের উচ্চাঙ সঙ্গীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
মীর মশাররফ হোসেনজন্ম : ১৩ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে ।
মৃত্যু : ১৯১০ সালে ।
মীর মোশাররফ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৩ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর লাহিনী পাড়ায়। তাঁর পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন। স্বগৃহে তিনি মুন্সির কাছে আরবী, ফারসী ও বাংলা শিক্ষা গ্রহণ করেন।
স্কুলজীবন কাটে প্রথমে নিজগ্রামের নন্দীর পাঠশালায়, কুমারখালী ইংরেজী স্কুল, পদমদী নবাব স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। কলকাতার কালিঘাট স্কুলে ভর্তি হলেও লেখাপড়ায় আর অগ্রসর হন নি। পরে নিজ গ্রামে ফিরে এসে পিতার সম্পতির দেখাশোনার ভার নেন।

নাদির হোসেনের সুন্দরী কন্যা লুৎফুন্নেসার সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানে কন্যা বদল করে নাদির হেসেন তার শ্রীহীনা বুদ্ধিহীনা মেয়ে আজীজুন্নেসাকে মীরের সঙ্গে বিবাহ দেন (১৯শে মে ১৮৬৫)। পরবর্তীতে মীর মোশাররফ হোসেন বিবি কুলসুমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন ফরিদপরের নবাব স্টেটে চাকরী করে। ১৮৮৫ সালে টাঙ্গাইলের দেলদার এস্টেটের ম্যানেজার হন। জমিদারের সঙ্গে মনমালিন্যের কারণে এবং স্থানীয় লোক ও কর্মচারীদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় তিনি লাহিনী পাড়া ফিরে আসেন। এরপর ভাগ্যান্বেষণে বগুড়া কলকাতা এবং শেষে পদমদীতে অবস্থান করেছিলেন।

মীর মশাররফ হোসেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও অন্যতম প্রধান লেখক। সমসাময়িক বা পিছিয়েপড়া মুসলমান সমাজের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক বেশি অগ্রসর। কাঙাল হরিণাথ সম্পাদিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা ও ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা দুটিতে তাঁর অনেক রচনাগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

মুহাম্মদ আব্দুল হাই বলেন- তিনি এ যুগের সাহিত্যিকদের পিতামহের মতো অলক্ষ্য আঙ্গুলি সঞ্চালনে তাঁদের আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মশাররফ হোসেনের সৃষ্টি সম্ভারের বৈচিত্র এবং ব্যাপ্তি বিস্ময়কর। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া মীর মশাররফ হোসেনের মতো বিচিত্র গদ্যরীতি আর কেউই সৃষ্টি করতে পারেন নি।

গ্রন্থসমূহ :
রত্নবতী (গল্প, ১৮৬৯),
গোরাই ব্রীজ অথবা গৌরী সেতু (কবিতা, ১৮৭৩),
বসন্তকুমারী (নাটক, ১৮৭৩),
জমিদার দর্পণ (নাটক, ১৮৭৩),
এর উপায় কি? (প্রহসন, ১৮৭৫),
বিসাদ-সিন্ধু (উপন্যাস, ১৮৮৫-১৮৯১),
সংগীত লহরী (প্রথম খন্ড, গান, ১৮৮৭),
গো-জীবন (প্রবন্ধ, ১৮৮৯),
বেহুলা গীতাভিনয় (নাটক, ১৮৮৯),
উ‌দাসীন পথিকের মনের কথা (উপন্যাস, ১৮৯০),
তাহমিনা (উ‌পন্যাস, ১৮৯৭),
টালা অভিনয় (প্রহসন, ১৮৯৭),
নিয়তি কি অবনতি (নাটক),
গাজী মিয়াঁর বস্তানী (নকশা, ১৮৯৯),
ভাই ভাই, এইতো চাই (আনুমানিক ১৮৯৯),
ফাস কাগজ (আনুমানিক ১৮৯৯),
বাঁধা খাতা (আনুমানিক ১৮৯৯),
মৌলুদ শরীফ (গদ্য-পদ্য, ১৯০৩),
মুসলমানের বাংলা শিক্ষা (প্রথম ভাগ, স্কুল পাঠ্যপুস্তিকা, ১৯০৩),
বিবি খোদেজার বিবাহ (কবিতা, ১৯০৫),
হযরত ওমরের ধর্ম জীবন লাভ (কবিতা ১৯০৫),
হযরত বেলালের জীবনী (কবিতা, ১৯০৫),
হযরত আমীর হামজার ধর্মজীবন লাভ (কবিতা, ১৯০৫),
মদীনার গৌরব (কবিতা, ১৯০৬),
মোসলেম বীরত্ব (কবিতা, ১৯০৭),
এসলামের জয় (গদ্য রচনা ১৯০৮),
মুসলমানের বাংলা শিক্ষা (দ্বিতীয় ভাগ, স্কল পাঠ্যপুস্তিকা, ১৯০৮),
বাজিমাৎ (নকশা, ১৯০৮),
আমার জীবনী (প্রথম খন্ড, আত্মজীবনী, ১৯০৮-১৯১০),
হযরত ইউসোফ (গদ্য রচনা, আনুমানিক ১৯০৮),
খোতবা (গদ্য রচনা),
আমার জীবনীর জীবনী, কুলসুম জীবনী (১৯১০)।

সম্পাদিত পত্রিকা : আজীজন-নেহার, হিতকরী।

সাহিত্যের আঙ্গিক বিচারে তাঁর রচনাগুলো পুরোপুরি সার্থক এমন মনে করেন না অনেকেই। তবে সময়ের বিচারে তাঁর রচনার ঐতিহাসিক মর্যাদা অনন্য ও অনস্বীকার্য। তাঁর রচনা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথপ্রদর্শকের মর্যাদায় আসীন।

তাঁর জীবনী একটি ঘটনাবহুল উ‌পন্যাসের মতো বৈচিত্রময়। তিনি ১৯১০ সালে ফরিদপুরের পদমদী তে মৃত্যবরণ করেন।
বিপ্লবী বাঘা যতীনজন্ম : ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর
মৃত্যু : ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর
“আমরা মরবো, জাতি জাগবে”- বিপ্লবী বাঘা যতীনের অমর উক্তি। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীন এভাবেই তাঁর আদর্শ প্রকাশ করেছেন।

বাঘা যতীন ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার) কয়া গ্রামে জন্ম। তাঁর বাবা উমেষচন্দ্র মুখার্জি এবং মা স্বরসতী। তাঁর পিতার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (যতীনের বয়স তখন ৫ বছর) তাঁরা ঝিনাইদহের সাধুহাটিতে দিনযাপন করেছেন।

১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করার পর তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ভর্তি হন। এরপর সাঁটলিপি ও টাইপ শেখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভার্নমেন্টের স্টেনোগ্রাফার নিযুক্ত হন। যতীন ছিলেন শক্ত সমর্থ ও নির্ভিক চিত্ত এক যুবক। অচিরেই তিনি একজন আন্তরিক, সৎ, অনুগত এবং পরিশ্রমী কর্মচারী হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে দৃঢ় আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ জন্মেছিল।

১৯০০ সালে যতীন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ইন্দুবালা ব্যানার্জিকে বিয়ে করেন। তাঁদের চার সন্তান : অতীন্দ্র (১৯০৩-১৯০৬), আশালতা (১৯০৭-১৯৭৬), তেজেন্দ্র (১৯০৯-১৯৮৯), বীরেন্দ্র (১৯১৩-১৯৯১)। ১৯০৬ সালে অতীন্দ্রের অকাল মৃত্যুতে শোকাভিভূত পুরো পরিবার নিজ গ্রাম কয়ায় ফিরে আসে। সেখানে জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় যতীন একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখোমুখি হন। বহুক্ষণ খালি হাতে ধ্বস্তাধ্বস্তির হয়, উভয়েই মারাত্বকভাবে জখম হন। এক পর্যায়ে যতীন একটি ছোট চাকু যোগাড় করতে সমর্থ হন এবং সেটা বাঘের গলায় বিধিয়ে বাঘকে হত্যা করেন । তাঁর সারা শরীরে বাঘের নখের বিষাক্ত আঁচড় পড়েছিলো। এটা ১৯০৬ সালের মার্চ মাসের ঘটনা । এরপর থেকে তাঁকে ‘বাঘা যতীন’ নামে ডাকা হয়।

বাঘা যতীন ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন জেলাতে এর শাখা স্থাপনের প্রধান ভূমিকা তাঁর। ১৯০০ সালের দিকে কলকাতায় এক গোপন মিটিং শেষে সরকার সমর্থক এবং সরকারী কর্মকর্তাদের নির্মূলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, গঠন করা হয় যুগান্তর নামে এক গোপন সংগঠন। এই সংগঠন বেশ কয়েকটি জেলাতে বিস্তার লাভ করেছিলো। তবে সবচেয়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিলো কুষ্টিয়াতে বাঘা যতীনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে । যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (এম. এন. রায়) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই একে অপরের আস্থাভাজন হন।

১৯০৮ সালে যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়। এ মামলার বিচারে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে যাবজ্জীবন নির্বাসন, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল এবং অনুশীলন সমিতিকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এবং নরেনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই বছরেই যতীন ‘যুগান্তর’ এর নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁরা হাওড়া-শিবপুর এলাকায় আত্মগোপন করেন এবং অন্যান্য বিপ্লবীর সাথে গুপ্তভাবে কাজ চালিয়ে যান।

যতীনকে পুনরায় ২৭ জানুয়ারি ১৯১০সালে হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং তার সাথে অন্যান্য যারা গ্রেফতার হন তাদের ‘যতীন গ্যাং’ নামে অভিহিত করা হয়। তাদের এমন নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয় যে, কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেন ও কয়েকজন পাগল হয়ে যান। ১৯১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এ মামলা থেকে অব্যহতি পান, তবে সরকারি চাকরী চলে যায়।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাঘা যতীন সেসময় ভারত সফররত তৎকালীন জার্মান যুবরাজের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছ থেকে গোপন অস্ত্র পাওয়ার নিশ্চয়তা আদায় করে নেন।

জেলে থাকা অবস্থায় যতীন এবং নরেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন করেন। তাঁরা দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন এবং এ উদ্দেশে নরেন সন্ন্যাসীরূপে ব্যপকভাবে সমস্ত ভারত ভ্রমণ করে বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ হুগলি এবং মেদিনীপুরের বন্যার ত্রাণকার্য উপলক্ষে একত্রিত হন। তাঁরা যতীন মুখোপাধ্যায় এবং রাসবিহারী বসুকে যথাক্রমে বাংলা ও উত্তর ভারতের নেতা মনোনীত করেন। ভারতবর্ষের বাইরেও বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহন করা হয়। সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিখ সম্প্রদায় স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপের ভারতীয় বিপ্লবীগণ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং এতে জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি যতীন মুখোপাধ্যায়ের নিকট একজন দূত পাঠান।

ইতোমধ্যে বাঘা যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চীফ করা হয়। যতীন বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) আত্মগোপনে থাকার সময় নরেনকে বাটাভিয়া পাঠান জার্মান কর্তৃপক্ষের সাথে অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ক আলোচনা করতে। জার্মান কর্তৃপক্ষ জাহাজে নরেনকে জানান ‘ভারতীয় বিপ্লবীদের সাহায্য করতে ইতোমধ্যে অস্ত্র পাঠানো হয়েছে, যা শিগগীরই পৌছে যাবে।

দ্রুতই ব্রিটিশ কতৃপক্ষ যতীনের গুপ্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায় । তারা পুলিশকে সতর্কাবস্থায় রাখে, বিশেষত গঙ্গা অববাহিকায়। এছাড়া তৎসংলগ্ন সমুদ্রবন্দর সীল করে দেয়। পুলিশ কাপ্তিপাড়া গ্রমের দিকে রওনা হয়। এখানে বাঘা যতীন সহযোগীদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন। যতীন আগেই অবগত হয়েছিলেন এবং তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলা হয়। কিন্তু তিনি সহযোগীদের বিপদের মুখে ফেলে যেতে চাননি । পরে সবাই মিলে যখন নিরাপদ গন্তব্যে রওনা হন ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। কলকাতা এবং বালেশ্বরের শীর্ষস্থানীয় অফিসারদের নেতৃত্বে সেনা এবং পুলিশ নিয়ে গঠিত বিশাল এক বাহিনী কাছে এসে পড়েছে।

বাঘা যতীন এবং তাঁর ৪ সহযোগী পাহাড়-পর্বত-জঙ্গল ভেঙে সরে যেতে থাকেন। অবশেষে ৯ সেপ্টেম্বর,১৯১৫সালে বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে । তাঁর সহযোগীরা আবারো তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলেন, কিন্তু এবারো তিনি সহযোগীদের ছেড়ে যেতে অসম্মতি জানান। আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত সরকারী বাহিনীর সাথে তাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। দেড় ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে সরকারী বাহিনীর অসংখ্য পুলিশ ও সেনা নিহত হয়। বাঘা যতীন ও যতীশ নামে তাঁর এক সহযোগী মারাত্বকভাবে আহত হন । তাঁর সহযোগীদের মধ্যে মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নিরেন ধরা পরেন; চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী নিহত হন।

পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে বালেশ্বরের হাসপাতালে পুলিশের গুলিতে বাঘা যতীন নিহত হন। এবং ভারতবর্ষকে আরো ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয় স্বাধীনতার জন্য।

বাংলার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বলেন, যদি জার্মান অস্ত্র পৌছে যেত, ব্রিটিশরা হেরে যেত।

‘আজ মহাত্মা গান্ধিকে হয়তো কেউ জানতো না, হয়তো বাঘা যতীনই হতেন ভারতের জাতির জনক।’- রস হেভ্চেক।
জগদীশ গুপ্ত জন্ম : ১৮৮৬ সালে।
মৃত্যু : ১৯৫৭ সালে।

জগদীশ গুপ্তের জন্ম ১৮৮৬ সালে কুষ্টিয়া শহরে । তাঁর আদি নিবাস ফরিদপুরের খোর্দমেঘচারী গ্রামে । তার পিতা কৈলাস চন্দ্র গুপ্ত কুষ্টিয়াতে ওকালতি করতেন।
রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের পর জগদীশ গুপ্ত বাস্তবতার একটি নতুন আয়তন নির্মান করেন। দূর্জ্ঞেয় নিয়তি, বিচিত্র মানব মন, নৈরাশ্যবাদী জীবন দর্শন জগদীশ গুপ্তের কথাসাহিত্যকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হলো বিনোদিনী (গল্প ১৯২৭), অসাধু সিদ্ধার্থ (উপন্যাস ১৯২৯), রোমন্থন (উপন্যাস ১৯৩০), অশ্যরা (কবিতা ১৯৩২), রূপের বাহিরে (গল্প ১৯৩০), লঘু-গুরু (উপন্যাস ১৯৩১), শ্রীমতি (উপন্যাস ১৯৩১), ষুতিনি (উপন্যাস ১৯৩৩), উদয় লেখা (উপন্যাস ১৯৩৩), তৃষিত সৃক্কনী (গল্প ১৯৩৩), রতি ও বিরতি (গল্প ১৯৩৫), উপায়ন (গল্প ১৯৩৫), শশাংক কবিরাজের স্ত্রী (গল্প ১৯৩৬), মেঘাবৃত অশনী (গল্প ১৯৪৭), মহিষী (উপন্যাস ১৯২৯), তাতল সৈকতে (উপন্যাস ১৯৩১), অন্ধজন শলাকা, দয়ানন্দ মল্লিক ও মল্লিকা (উপন্যাস ১৯৩৯), নিষেধের পটভূমিকায় (উপন্যাস ১৯৫২), পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক (গল্প ১৯২৯), কল্যান ও সুরভী (কবিতা ), যথাক্রমে (উপন্যাস ১৯৩৫), নন্দ আর কৃষ্ণা (উপন্যাস ১৯৪৭), দুলালের দোলা (উপন্যাস), নিদ্রিত কুম্ভ কর্ণ (যৌথ উপন্যাস), জয়া (যৌথ উপন্যাস), জগদীশ গুপ্ত গ্রন্থাবলী (১৯৩৫), স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৫৯), কলঙ্কিত তীর্থ (১৯৭৭), জগদীশ গুপ্ত রচনাবলী (১৯৭৮, ১ম খন্ড, নিরঞ্জন চক্রবর্তী সম্পাদিত), পত্রিকা : গুপ্তের গল্প।

তিনি ১৯৫৭ সালে পরলোক গমন করেন।

শ. ম. শওকত আলীজন্ম : ১৯৩৯ সালের ৩১শে অক্টোবর
মৃত্যু : ২০০১ সালে ২৬শে ডিসেম্বর
কুষ্টিয়ার ইতিহাস, কুষ্টিয়া জেলায় ইসলাম গ্রন্থ দুটির প্রণেতা হিসেবে তিনি এক নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি শ. ম. শওকত আলী।

কুষ্টিয়ার যেসব কৃতিসন্তান অনেকটা নিভৃতে থেকেই কুষ্টিয়ার জন্য অবদান রেখে গেছেন শ. ম. শওকত আলী তাদের অন্যতম। কেবল শিক্ষক হিসাবে নয় মানুষ হিসাবেও তিনি ছিলেন সদালাপী, নিরহংকারী। তাঁর চিন্তা ভাবনা ধ্যান ধারণার অনেকটা জুড়ে ছিল কুষ্টিয়া । কালের প্রবাহে ফিকে হয়ে আসা কুষ্টিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মেরের কাছে তুলে ধরার তাঁর যে প্রয়াস সে দিক থেকে কুষ্টিয়াবাসী তাঁর কাছে চির ঋণী হয়ে থাকবে। তিনি কুষ্টিয়াকে সবার সামনে তুলে ধরতেই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

ছাত্রদের তিনি অপত্য স্নেহে আপন করে নিতেন। অনেককে তিনি লেখাপড়ায় মনোযোগী করেছিলেন। পথ ভুলে হয়ত তারা হারিয়ে যেতে পারত কোন অন্ধকার জগতে তিনি তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন । তাঁর অসংখ্য ছাত্র ছড়িয়ে আছে সারা দেশ জুড়ে, কেউ হয়েছেন প্রবাসী ।

উদার চিত্ত, অসাম্প্রদায়িক হৃদয়ের এই মানুষটির জন্ম ১৯৩৯ সালের ৩১শে অক্টোবর সাবেক নদীয়া জেলার কুমারখালী থানার আমবাড়ীয়া গ্রামে ।

শিক্ষা জীবনঃ
ছোটবেলা থেকে তিনি অসম্ভব মেধাবী ছিলেন কুমারখালী সেনগ্রামের ছাত্র হিসাবে তিনি খুলনা বিভাগে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় খুলনা বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন । কুষ্টিয়া মুসলিম হাইস্কুল থেকে ইতিহাসে লেটার সহ এস.এসসি পাশ করেন ১৯৫৬ সালে । কুষ্টিয়া কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচ. এসসি পাশ করেন উক্ত কলেজ থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের অধীনে বি.এ পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৬১ সালে । ঐ সময়ে কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন । রাজশাহী টিচার্স টেনিং কলেজ থেকে বি.এড. ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয় থেকে বাংলায় এম. এ পরিক্ষায় পাশ করেন ১৯৭২ সালে ।

পেশাঃ
শিল্পপতি মোহিনী মোহন প্রতিষ্ঠিত মোহিনী মোহন বিদ্যাপীট স্কুলে তার শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। অত্যন্ত যোগ্যতা ও সুনামের সাথে প্রায় দশ বছর শিক্ষকতা করেন । এরপর কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে যোগদান করে অবসর গ্রহনের আগ পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৯৫ সালে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি ১৯৯৭ সালে আলাউদ্দিন আহম্মেদ কলেজিয়েট স্কুল ও টির্চাস ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে।

সাংগাঠনিক কর্মকান্ডঃ
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। শত বাধা বিপত্তি এড়িয়ে সমাজের জন্য কিছু করার চেষ্টা তার ছিল। তিনি ছিলেন কুষ্টিয়া সাহিত্য পরিষদ, কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমি, কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী, কুষ্টিয়া লালন একাডেমির সদস্য ও বাংলা একাডেমির ভূতপূর্ব সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কুষ্টিয়া ইউনিটের ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্য। মানবাধিকার কমিশন কুষ্টিয়া শাখার সভাপতি, কুষ্টিয়া প্রবীন হিতৈষী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ কুষ্টিয়া শাখা সহ সাধারন সম্পাদক ছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কুষ্টিয়া জেলা শাখার উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ও এডহক কমিটির সদস্য ছিলেন ।

সাহিত্য কর্মঃ
তিনি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও সংকলনে গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, প্রবন্ধ লিখতেন । তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থ কুষ্টিয়ার ইতিহাস (১৯৭৮), কুষ্টিয়া জেলায় ইসলাম (১৯৯২) । এছাড়াও তাঁর গৃহে প্রচুর পান্ডুলিপি রেখে গেছেন। তাঁর সর্বশেষ সাহিত্য প্রচেষ্টা ছিল কুষ্টিয়ার ইতিহাসের নবতর সংস্করণ প্রকাশ করা। তিনি এর পান্ডুলিপিও সম্পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু তা প্রকাশ করে যেতে পারেন নি।

তিনি ১৯৫৯ সালে কুষ্টিয়া জেলার মজমপুরের বিশিষ্ট চৌধুরী পরিবারের হালিমা খাতুনকে বিবাহ করেন। তাঁর তিন পুত্র চার কন্যা ।

এই মহান শিক্ষক, ইতিহাসবিদ, সাহিত্যানুরাগী, সদালাপী মানুষটি ২০০১ সালে ২৬শে ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন